ডেস্ক নিউজ:

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বা আহত হওয়ার ঘটনায় দায়ীদের শাস্তি চাওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ চেয়েও আদালতে মামলা করতে পারেন পরিবার ও স্বজনরা। টর্ট আইনে রয়েছে এই সুযোগ। তবে বিভিন্ন আইনের সীমাবদ্ধতা ও অতিরিক্ত কোর্ট-ফির কারণে ক্ষতিপূরণ মামলার সংখ্যা কম। এ বিষয়ে দেশের আইনজীবীরাও তেমন আগ্রহ দেখান না বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। তবে সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের মামলা হচ্ছে এবং নিজেদের পক্ষে রায়ও পাচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।

সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে ৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে রবিবার (৩ ডিসেম্বর) নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী তিন মাসের মধ্যে বাস মালিক, চালক ও সংশ্লিষ্ট বীমা প্রতিষ্ঠানকে এই টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে বাসচালক ৩০ লাখ, বাস মালিক ৪ কোটি ৩০ লাখ ৯৫ হাজার ৪৫২ ও রিলায়েন্স ইনস্যুরেন্সকে ৮০ হাজার টাকা দিতে হবে। এই রায়ের পর মূলত সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ মামলায় প্রতিকার পাওয়ার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।

১৯৮৯ সালে দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু মতিঝিলে বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন। এর দুই বছর পর তার স্ত্রী রওশন আরা আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়ে বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ২৫ বছর পর ২০১৪ সালের ২০ জুলাই সাংবাদিক মন্টুর পরিবারকে ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত কাউকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে রায় ঘোষণা দেশে এটাই প্রথম বলে জানান রওশন আরার আইনজীবী খলিলুর রহমান। যদিও দুর্ঘটনার দীর্ঘ ২৭ বছরেও ক্ষতিপূরণ পায়নি এই পরিবার।

বাদী রওশান আরা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুর্ঘটনার সময় আমাদের বড় ছেলের বয়স ৯ বছর আর ছোট ছেলে ছিল ৫ বছরের। তখনই আমি মামলা করেছিলাম। এই ২৭ বছরেও আমরা ক্ষতিপূরণ পাইনি। উল্টো ১৯৯১ সালে নিম্ম আদালতের রায় দেওয়া ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ কমতে কমতে ১ কোটি ৬৯ লাখে এসে ঠেকেছে। গত ২৭ বছরে এই মামলা চালাতে গিয়ে সব হারিয়েছি। কিন্তু কিছুই পাইনি। এখনও মামলা চলছে।’

রওশান আরার আইনজীবী খলিলুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা রায় পেয়েছি। তবে বিবাদী পক্ষ টাকা দেয়নি। আমরা জারি মামলা (রায় বাস্তবায়নের জন্য নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাওয়ার পর যে মামলা করা হয়) করেছি। তারপরও টাকা পাইনি। অবশেষে আদালত তাদের সম্পত্তি ক্রোক করেছে। তেজগাঁওয়ের জায়গা নিলামে বিক্রির নির্দেশ দিয়ে টাকা পরিশোধের সিদ্ধান্ত দিয়েছে। তবে নিলামে জায়গা বিক্রি করা যাচ্ছে না। বর্তমানে এই অবস্থায় আছে।’

এই আইনজীবী বলেন, ‘আমাদের দেশে ক্ষতিপূরণ মামলা করার প্রচলন তেমন নেই। কারণ ক্ষতিপূরণ মামলা মূলত টর্ট আইনেই করতে হয়। এই আইনের মাধ্যমে মামলা দায়ের করে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ আদায় করা সম্ভব, তবে আইনজীবীদের অনীহার কারণে তা ফলপ্রসূ হয় না।’

সাধারণ অর্থে টর্ট বলতে বোঝায় কোনও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদান। তাই টর্ট আইনেই সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের মামলা করা আইনগত সবচেয়ে ভালো দিক বলে মনে করেন আইনজীবী খলিলুর রহমান। টর্ট আইনে ক্ষতিপূরণ মামলা করার নিয়ম জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যদি কোনও ব্যক্তি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন, তার পরিবার বা স্বজনরা একজন আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করবেন। এক্ষেত্রে দুটি মামলা হতে পারে, একটি নিহতের ঘটনায় বিচারের আর্জি। অন্যটি ক্ষতিপূরণ মামলা।’

মামলা করার ক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তির পেশা, আয় ও আয়ু বিবেচনা করা হয় বলে জানান আইনজীবী খলিলুর রহমান। অর্থাৎ একজন কর্মক্ষম ব্যক্তি বেঁচে থাকলে কী পরিমাণ অর্থ আয় করতেন, কতদিন বাঁচতেন ইত্যাদি। তার সেই আয় দিয়ে কী কী হতো এসব তথ্য উল্লেখসহ টর্ট আইনে মামলা করা যায়। তবে টাকার অংক বেশি হলে কোর্ট ফি বেশি হয়। টাকার অংকের ওপর এই ফি নির্ধারণ করা হয়। এর ক্যাটাগরি করা আছে। এই ফি এতই বেশি যে অসচ্ছলদের পক্ষে ক্ষতিপূরণ মামলা করা অসম্ভব। এ কারণেই অনেকে ক্ষতিপূরণ মামলা করতে যায় না। তাছাড়া সময়ক্ষেপণও হয়।’

আইনজীবী খলিলুর রহমানের ভাষ্য, ‘মামলার পর কবে নাগাদ ক্ষতিপূরণ পাবেন, তা আসলে নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারবে না। এ কারণেই মানুষের মধ্যে এই মামলা করার ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহ দেখা যায় না।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ূম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মোটর ভেহিক্যালস অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর বিষয় অনেকেরই জানা নাই। তাই ক্ষতিপূরণ মামলা করতে কেউ আসে না। ২০১৫ সালের মোটর ভেহিক্যালস অধ্যাদেশ এখনও খসড়া হিসেবেই আছে। তবে এসব আইনের বাইরে গিয়েও টর্ট আইনে ক্ষতিপূরণ মামলা দায়ের করা যায়। কেউ যদি মনে করেন তিনি কোনও ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তবে তিনি ক্ষতিপূরণ মামলা করতে পারেন। সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনাগুলোতেও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার টর্ট আইনে মামলা করতে পারবেন। তাছাড়া গতকাল (রবিবার) আদালত পর্যবেক্ষণে যে রায় দিয়েছেন, সেখানেও ক্ষতিপূরণের মামলা করার সুযোগ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে।’

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির ক্ষেত্রে অপরাধীর শাস্তি হওয়ার নজির কম। আবার কখনও কখনও ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে সালিশ বৈঠকের মাধ্যমেও মীমাংসা হয়। চালকরা দুর্ঘটনা ঘটালে দায়িত্ব মালিকের ওপর বর্তায় বলে জানিয়েছেন আইনজীবী খলিলুর রহমান। তার কথায়, ‘টর্ট আইনে দায়ের করা মামলার ক্ষেত্রে কোন ঘটনায় কার দায়িত্ব কতটুকু তা নির্ণয়ের সুযোগ আছে। চালক কোনও ত্রুটি করলে তার দায় মালিককে নিতে হবে। কারণ মালিক তাকে সচেতন করেননি। এজন্য মালিকই ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। ভুক্তভোগীরা ক্ষতিপূরণ পাবেনই।’

২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের জোঁকা এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও চিত্রগ্রাহক-সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ কয়েকজন। সড়কে বিশিষ্টজনদের মৃত্যুর ঘটনা আরও আছে। ২০১৪ সালের ২৯ নভেম্বর কাওরান বাজার এলাকায় বাস থেকে নামতে গিয়ে পেছনের চাকায় পিষ্ট হয়ে নিহত হন রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসসের সাবেক প্রধান সম্পাদক জগলুল আহমেদ চৌধুরী।

নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় চার হাজার ১৪৪ জন নিহত ও পাঁচ হাজার ২৫৫ জন আহত হয়েছেন। ২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার তিনজন। ২০১৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছিল ৫ হাজার ৯২৮টি। এগুলোতে নিহতের সংখ্যা ৮ হাজার ৫৮৯ জন। আর আহত হন ১৭ হাজার ৫২৪ জন।